শিপলু জামান, ঝিনাইদহ :
নাম মিরাজুল হক। বয়স ৬০ বছর, সারা জীবন হকারী করে জীবিকা নির্বাহ করার কারনে সাবাই তাকে ফেরিওয়ালা মিরাজ আবার কেউ মিরাজ পাগল বলেই জানে। সে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ শহরের কলেজপাড়ার মৃত ইব্রাহিম মোল্ল্যার ছেলে।
স্ত্রী জুলেখা বেগম, দুই ছেলে আর দুই মেয়েকে নিয়ে তার পরিবার। দুই মেয়ে শারমিন সুলতানা মিনা ও পারভিন সুলতানা মুক্তার বিয়ে হয়ে গেছে। দুই ছেলে জাহাঙ্গীর আলম ও আলমগীর মোল্ল্যাা। হকারী করেই দুই ছেলেকে লেখাপড়া করাচ্ছেন। বড় ছেলে জাহাঙ্গীর আলম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজ কল্যাণ ও গবেষণা বিষয়ে মাস্টার্স শেষ করে বিসিএস পরীক্ষা দিচ্ছেন। আর ছোট ছেলে আলমগীর মোল্ল্যাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্বধর্ম ও সাংস্কৃতি বিষয়ে দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্রের প্রিমিয়ার লীগের নিয়মিত ফুটবল খেলোয়াড়।
চোখে-মুখে অভাব অনাটনের ছায়া। ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ মেইন বাসস্ট্যান্ডে কখনও তিলের খাজা, কখনও ঝুরি ভাজা, কখনও হাতপাখা-রুমাল, আবার কখনও কলা কিংবা অন্যান্য ফলমূল ফেরি করে বিক্রি করেন। হতদরিদ্র মানুষটি শেষ কবে নিজের গায়ের পোশাক কিনেছেন তাও বলতে পারেন না। প্রাইমারি পর্যন্ত লেখাপড়া করলেও অভাব অনাটনের কারণে আর পড়তে পারেননি। কিন্তু নিজ উদ্যোগে অনেক বই পুস্তক পড়ে নিজেকে স্ব-শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলেছেন।
নিজে দুবেলা দুমুঠো খেতে না পারলেও অর্থের অভাবে শিক্ষা থেকে ছিটকে পড়া মানুষগুলোকে বই পড়ার মাধ্যমে মৌলিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখান তিনি। হকারি করে প্রায় তিন লাখ টাকা দিয়ে কিনেছেন চার শতাধিক বিভিন্ন প্রকারের বই। এখন একটি পাঠাগার স্থাপনের অপেক্ষায় আছেন তিনি। কিন্তু তার সহযোগীতায় এগিয়ে আসেনি কেউ। শহরের এক কোনেও ঠাই মেলেনি তার প্রতিষ্ঠা করা বঙ্গবন্ধু স্মৃতি পাঠাগারটি । কলেজপাড়া গ্রামের পরিতোষ বাবু বলেন, ফেরিওয়ালা মিরাজুল অর্থ জমিয়ে নিজ চেষ্টায় তৈরী করেছেন পাঠাগার। আমরা অবসর সময়ে তার পাঠাগারে গিয়ে বই পড়ে সময় কাটায় ।
ফেরিওয়ালা মিরাজুল মনে করেন, পাঠাগার থাকলে এলাকার গৌরব উজ্জ্বল হয়। ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতে ও জানাতে ভূমিকা পালন করে একটি পাঠাগার। এমন উপলদ্ধি থেকে তিনি নিজ এলাকা কলেজ পাড়ায় প্রতিষ্ঠা করেন বঙ্গবন্ধু স্মৃতি পাঠাগার। কিছুদিন নিজ ব্যয়ে পাঠাগারটি চালানোর পর এখন অর্থ, জায়গা আর পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে পাঠাগারটি চালাতে পারছেন না। পাঠাগারের অভাবে চার শতাধিক বই রেখেছেন নিজের ঝুপড়ি ঘরে।
অনেক কষ্টের পরও বঙ্গবন্ধুর নামে স্থাপিত পাঠাগারটি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে আলোর মুখ দেখছে না।’ তিনি চান পাঠাগারটি আলোর মুখ দেখুক। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ জ্ঞান অন্বেষণে পাঠাগারে এসে মিলন মেলার বন্ধনে আবদ্ধ থাকুক।
মিরাজুল হকের স্ত্রী জুলেখা বেগম বলেন আমরা অনেক অভাবী মানুষ, স্বামী সারাজীবন মেইন বাসষ্ট্যান্ডে হকারি করে আর আমি সংসার সামলায়। এতো অভাবের মধ্যেও মেয়েদের বিয়ে দেওয়া হয়েছে। দুই ছেলেকে ভার্সিটিতে লেখাপড়া করিয়েছি। সে সারাজীবন বঙ্গবন্ধুর আদর্শের মানুষ, ভালোবাসেন আওয়ামী নামক দলটি। তার নেশা বই কেনা, বই কেনা নেশা থেকে আমি তাকে ফেরাতে পারিনি। বঙ্গবন্ধুর নামে পাঠাগার নির্মানের জন্য কেউ তার সাহায্যে এগিয়ে আসেনননি। তাই তিনি পাঠাগার নির্মানে প্রধানমন্ত্রীসহ সকলের সহযোগীতা চান।
মিরাজুল হক বলেন, অভাব অনাটনের জন্য তিনি লেখাপড়া করতে পারেননি। কোন রকম প্রাইমারি শেষ করে ১৯৭৮ সাল থেকে কালীগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডে হকারি করে জীবীকা নির্বাহ করছি। বর্তমানে মাসে ৯ থেকে ১০ হাজার টাকা আয় হয়। তাই দিয়ে সংসার চালানোসহ ছেলেদের লেখাপড়া শেখানো ও মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। লেখাপড়া শিখতে না পারার আক্ষেপ । তিনি ছোট বেলায় বিভিন্ন রকমের বই পড়তে থাকেন। আর সেখান থেকেই বই কেনার নেশায় পড়েন। বঙ্গবন্ধুর প্রতিও রয়েছে তার অগাধ ভালবাসা। নিজেকে তিনি বই প্রেমিক ও বঙ্গবন্ধুর সৈনিক বলে দাবি করেন।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা মন্টু গোপাল বাবু বলেন, আগামী প্রজন্মের মাঝে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের সকল স্মৃতি তুলে ধরতে মিরাজুলের বঙ্গবন্ধু স্মৃতি পাঠাগাটি খুবই প্রয়োজন। মিরাজুল হক পাঠগারটি দাঁড় করাতে দীর্ঘদিন ধরে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
যুগে যুগে জন্ম নিক ফেরিওয়ালা মিরাজুল হকের মতো জ্ঞানের আলো ছড়ানো মানুষদের। ঘরে ঘরে পৌছে যাক জ্ঞানের আলো। আলোকিত হোক সমাজ ও সমাজের মানুষ। আগামী প্রজন্মের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে দিতে এবং বঙ্গবন্ধু ও মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতিকে স্বরনীয় করে রাখতে শহরে প্রতিষ্ঠা পাক মিরাজুল হকের স্বপ্নের বঙ্গবন্ধু স্মৃতি পাঠাগারটি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, স্থানীয় সংসদ সদস্য, জনপ্রতিনিধি ও সূধী সমাজের সু-দৃষ্টি কামনা করেন এলাকাবাসী।