হোম আন্তর্জাতিক ব্লুমবার্গে মিহির শর্মার নিবন্ধ: হালে পানি পাচ্ছে না বাংলাদেশে বাইডেনের ‘গণতন্ত্র রক্ষার ক্রুসেড’

আন্তর্জাতিক ডেস্ক:

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গের এক নিবন্ধে। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে গণতন্ত্র রক্ষার নামে রীতিমতো ক্রুসেড ঘোষণা করেছে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন। তবে তাদের এই ক্রুসেড হালে পানি পাচ্ছে না।

কলামিস্ট ও নয়াদিল্লির অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সিনিয়র ফেলো মিহির শর্মার লেখা নিবন্ধটিতে বাংলাদেশের উন্নয়ন ও জাতীয় নির্বাচন ঘিরে অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপসহ নানা প্রসঙ্গ উঠে এসেছে।

নিবন্ধের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বাংলাদেশের নজিরবিহীন উন্নয়নের প্রশংসা করে বলা হয়েছে, অর্থনৈতিকভাবে এক দশক ধরে সফলতার গল্পই লিখে চলেছে বাংলাদেশ। এই সময়ে প্রবৃদ্ধি ছিল ধারাবাহিকভাবে ৬ শতাংশের ওপরে এবং ২০১৬ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে গড় প্রবৃদ্ধি ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপিন্সকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশ খুব শিগগিরই দরিদ্র দেশগুলোর তালিকা থেকে বের হয়ে আসবে। বিভিন্ন বাণিজ্য সুবিধা ও উন্নয়ন সহযোগিতারও আর দরকার হবে না।

মিহির শর্মা তার নিবন্ধে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সাল থেকে ক্ষমতায় রয়েছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে তার দল নিরঙ্কুশ জয় নিশ্চিত করে। যদিও বিরোধীদের পক্ষ থেকে ওই নির্বাচন নিয়ে অভিযোগ রয়েছে।

বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রসঙ্গ তুলে মিহির শর্মা লেখেন, কয়েক মাস পরই আরও একটি জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। এ নির্বাচন সামনে রেখে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে রীতিমতো ক্রুসেড ঘোষণা করেছে বাইডেন প্রশাসন। তবে যুক্তরাষ্ট্র কেন হঠাৎ বাংলাদেশকে মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে রাখার সিদ্ধান্ত নিলো, সেটার কারণ খুঁজে বের করাও বেশ কঠিন।

গতমাসে এক বিবৃতিতে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর এক ঘোষণায় জানায়, তারা ‘বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ন করায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য, ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের সদস্যসহ কমপক্ষে তিন শ্রেণির বাংলাদেশির ওপর ভিসা নীতি প্রয়োগের পদক্ষেপ নিয়েছে। শিগগিরই তালিকায় আরও নাম যোগ হবে বলেও বিবৃতিতে ইঙ্গিত দেয়া হয়।

মিহির শর্মার মতে, কোনো স্বাধীন দেশকে এভাবে সরাসরি হুমকি দেয়া ন্যায়সংগত বা সুবিবেচনাপ্রসূত কোনো কাজ নয়। তিনি বলেন, এটা ঠিক যে, আওয়ামী লীগের শাসনামলে পুলিশ ও অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে ক্রমেই রাজনীতিকরণ হয়েছে। ২০১৩ সালে একটি বিক্ষোভ দমনে অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগের অভিযোগে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করার দায়ে একটি মানবাধিকার সংস্থার দুই নেতাকে সম্প্রতি আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট নামে নতুন একটি আইনে পুলিশকে তল্লাশি ও গ্রেফতারের অভূতপূর্ব ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, সহজেই যার অপব্যবহার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

‘এরপরও মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ন্যায়সংগত নয়। এ পদক্ষেপের ফলে বাংলাদেশকে আলাদা করে টার্গেট করা হচ্ছে বলেই প্রতীয়মান হয়। কেননা, মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর লাইবেরিয়া, সিয়েরা লিওন ও নাইজেরিয়াসহ কয়েকটি দেশের ওপর অনুরূপ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। তবে থাইল্যান্ড ও পাকিস্তানসহ কয়েকটি দেশে তাদের সেনাবাহিনী নির্বাচনে প্রকাশ্যে হস্তক্ষেপ করলেও দেশগুলোর ওপর পদক্ষেপ নেয়া থেকে বিরত থেকেছে যুক্তরাষ্ট্র,’ নিবন্ধে বলেন মিহির শর্মা।

নিবন্ধে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের এই নীতি সুবিবেচনাপ্রসূত নয়। এতে তাদের পক্ষপাতমূলক চেহারাই প্রকাশ পাচ্ছে। জো বাইডেন প্রশাসনের এমন অপতৎপরতা নিয়ে বাংলাদেশি রাজনীতিবিদদের মধ্যেও ক্রমেই ক্ষোভ বাড়ছে।

মিহির শর্মা বলেন, রাজনীতিকরা একে অপরের বিরুদ্ধে মার্কিন দূতাবাসে গিয়ে নালিশ করছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি বিবিসিকে এক সাক্ষাৎকারে সরাসরি বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র হয়তো আর আমাকে ক্ষমতায় চায় না।’ ফলে ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করার নামে যে কোনো পদক্ষেপ এখন প্রশ্নের মুখে পড়বে।

নিবন্ধে বলা হয়, ওয়াশিংটনে বসে কেউ হয়তো ভাবছেন যে, ভারত ও তুরস্কের মতো দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের গুরুত্ব খুবই কম। যদি এমনটি ভাবা হয়, তাহলে সেটা হবে অদূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গি। বাংলাদেশকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য অনেক বেশি মূল্যও চুকাতে হবে। কেননা, এটি জনসংখ্যার বিচারে বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম দেশ। একইসঙ্গে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ, যেখানে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠায় একটা প্রবল লড়াই জারি রয়েছে। যে লড়াইয়ে মৌলবাদী শক্তিগুলো পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে।

এটি ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের একটি সুইং স্টেট তথা দোদুল্যমান রাষ্ট্রও। চীন বাংলাদেশকে নিয়ন্ত্রণের জন্য সময় ও অর্থ ব্যয় করছে। জ্বালানি ও পরিবহন খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ করছে। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২২ সালে বাংলাদেশের প্রায় ৯০ শতাংশ জ্বালানি প্রকল্পই চীনা অর্থের ওপর নির্ভরশীল ছিল।

নিবন্ধ অনুসারে, ওয়াশিংটন একের পর এক ভুল পদক্ষেপ নিলেও ভারত থেকে শুরু করে ফ্রান্স ও জাপান বাংলাদেশের পাশেই রয়েছে। চলতি বছরের আগস্ট মাসেই জাপান ঘোষণা করেছে, বাংলাদেশ সেই চারটি দেশের একটি, যারা একটি নতুন কর্মসূচির অধীন প্রতিরক্ষা সহায়তা পাবে।

এরপর গত মাসেই ঢাকা সফর করেছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। এই সফরে বাংলাদেশের অবকাঠামো, স্যাটেলাইট কর্মসূচির পাশাপাশি আরও প্রতিরক্ষা সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি।

এদিকে বাংলাদেশের ওপর মার্কিন চাপের বিষয়ে প্রকাশ্যেই অসন্তোষ জানিয়েছে চীন। দেশটির প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং গত আগস্টে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে এক বৈঠকে কথা দিয়েছেন, বিদেশি হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে সবসময় তিনি বাংলাদেশের পাশেই থাকবেন।

নিবন্ধে বলা হয়েছে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) বাংলাদেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল। তবে দল দুটির শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে একটি ব্যক্তিগত রেষারেষি রয়েছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেত্রী শেখ হাসিনার বয়স এখন ৭৬। তার প্রধান প্রতিপক্ষ খালেদা জিয়া ৭৮ বছর বয়সি। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ভীত যথেষ্ট শক্তিশালী, যা পরবর্তী প্রজন্মের নেতাদের জন্য নতুন পথ তৈরিতে সহায়তা করবে।

তবে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে যদি মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির উপকরণ হিসেবে দেখা হয়, তাহলে তেমনটা ঘটবে না। বাইডেন প্রশাসনের কর্মকাণ্ড সেই ঝুঁকিই তৈরি করছে। বিশেষ করে যদি এমন পদক্ষেপ অসংগত বা অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে চলতেই থাকে।

সম্পর্কিত পোস্ট

মতামত দিন