জাতীয় ডেস্ক :
বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি প্রায়ই উদ্বেগ প্রকাশ করতে দেখা যায় দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংগঠনকে। বিশেষ করে ‘নিখোঁজ’ বা ‘গুম’ হওয়া ব্যক্তিদের নিয়ে। তবে সরকারের বিরুদ্ধে এ ধরনের ঢালাও অভিযোগ যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, তা প্রমাণিত হয়েছে ‘নিখোঁজ’ অনেক ব্যক্তির ফিরে আসার মধ্য দিয়ে।
এসবের নেপথ্যে বাংলাদেশের কয়েকটি সরকারবিরোধী এনজিওর ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য কারা, কীভাবে গুমকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে, সম্প্রতি তার একটি চিত্র তুলে ধরেছেন ‘সুচিন্তা ফাউন্ডেশন’-এর নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ এ আরাফাত।
সম্প্রতি ‘রিয়েল ক্লিয়ার ওয়ার্ল্ড’-এ প্রকাশিত এক নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, বাংলাদেশ সরকার রাজনৈতিক বিরোধীদের ‘গুম’ করা নিয়ে মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলোর অভিযোগ দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেছে। কারণ, এসব অভিযোগ খুবই দুর্বল এবং এর সমর্থনে যেসব প্রমাণ হাজির করা হচ্ছে, তা-ও অস্তিত্বহীন।
নিবন্ধে বলা হয়, সরকারের বিরুদ্ধে যারা এ ধরনের অভিযোগ আনছেন, তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন সন্দেহভাজন। কারণ, তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক এজেন্ডা রয়েছে। এর মধ্যে একজন ‘অধিকার’ নামক একটি সংস্থার নির্বাহী পরিচালক আদিলুর রহমান খান। যিনি সরকারের কড়া সমালোচক হিসেবে পরিচিত এবং ২১ বছর আগে বিএনপি-জামায়াত জোট শাসনামলে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল।
আদিলুর রহমানেরও অতিরঞ্জনের ইতিহাস আছে। ২০১৩ সালে মতিঝিল শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের বিক্ষোভ চলাকালে ৬১ জন মারা যাওয়ার কথা জানান তিনি। পরে গণমাধ্যমের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, আদিলুর রহমান যাদের মৃত হিসেবে তালিকাভুক্ত করেন, তাদের অনেকেই সেদিন নিজ নিজ মাদ্রাসায় ক্লাস করেছে।
নিবন্ধে মোহাম্মদ এ আরাফাত লিখেছেন, অভিযুক্ত আরেকজন ডেভিড বার্গম্যান। নিজেকে সাংবাদিক দাবি করলেও, বছরের পর বছর ধরে তিনি সরকারের নিরলস সমালোচক। এছাড়া তার শ্বশুর ড. কামাল হোসেন আওয়ামী লীগবিরোধী রাজনৈতিক জোট ঐক্যফ্রন্টের প্রধান নেতা ছিলেন। অভিযোগ করা আরেকজন হলেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তার পিতা সৈয়দ মহিবুল হাসান আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল জিয়াউর রহমানের মন্ত্রিসভায় শ্রম ও জনশক্তি প্রতিমন্ত্রী ছিলেন।
মোহাম্মদ এ আরাফাত বলেন, বিশ্বাসযোগ্য হওয়ার জন্য যারা মানবাধিকার নিয়ে কাজ করেন, তাদের পক্ষপাতদুষ্ট হওয়া উচিত নয়। কিন্তু বাংলাদেশে প্রায়ই এমনটা ঘটছে।
জাতিসংঘের একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ সম্প্রতি বাংলাদেশে ‘জোরপূর্বক গুমের’ শিকার ৭৬ জনের একটি তালিকা প্রকাশ করে। ওই তালিকায় থাকা ৭৬ জনের মধ্যে ২৮ জন খুন থেকে শুরু করে মাদক বিক্রিসহ নানা অপরাধে অভিযুক্ত। তাদের কেউ কেউ কারাগারে রয়েছেন এবং আদৌ ‘নিখোঁজ’ হননি। অন্যরা জামিনে আছেন এবং অনেকে নিজেদের বাড়িতেই আছেন। অথচ বিতর্কিত এ তালিকা ধরেই বাংলাদেশকে বারবার অভিযুক্ত করা হয়েছে।
সুপরিচিত মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল সম্প্রতি ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়া টুডেতে উল্লেখ করেছেন, মানবাধিকার নিয়ে বিএনপির মিথ্যাচারের ইতিহাস রয়েছে। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেছেন, জাতিসংঘের প্রতিবেদনে এত বেশি ত্রুটি রয়েছে যে, এর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা উচিত।
নিবন্ধে আরও বলা হয়, সানায়াইমা রাজকুমার (প্রকৃত নাম রাজকুমার মেঘান) নিখোঁজ হিসেবে জাতিসংঘের তালিকাভুক্ত। তবে তিনি ভারতে বন্দি ছিলেন এবং বর্তমানে তার পরিবারের সঙ্গেই রয়েছেন। এছাড়া বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার আগেই চট্টগ্রামের কল্পনা চাকমা, বরিশালের মোহাম্মদ শফিক উল্লাহ মোনায়েম এবং গাজীপুরের মো. হাসান খানসহ নিখোঁজ হওয়া কয়েকজনকে ওই তালিকায় রাখা হয়েছে।
এছাড়াও সাবেক সেনা কর্মকর্তা মো. হাসিনুর রহমান, অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা মো. আবদুল্লাহ আল ফারুক, রংপুরের মোহাম্মদ আখতার হোসেন ও খোন্তাকাটার (বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলা) মো. আলতাফ হাওলাদার নিখোঁজের তালিকায় থাকলেও, বাস্তবে তারা কর্মরত এবং নিজ নিজ বাড়িতেই বসবাস করছেন। তালিকায় থাকা মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম একটি মাজারে লুকিয়ে ছিলেন, যা জানত না তার পরিবারও।
কবি ও সরকারের সমালোচক ফরহাদ মজহার ২০১৭ সালে নিজেকে অপহরণের নাটক সাজিয়েছিলেন। কিন্তু ওই ঘটনার ১৮ ঘণ্টা পর একটি বাস থেকে তাকে ‘উদ্ধার’ করেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তারা। ২০১৫ সালে বিভিন্ন অপরাধে দোষী সাব্যস্ত বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ গ্রেফতার এড়াতে পালিয়ে ভারতে যান। কিন্তু তাকেও নিখোঁজ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
মোহাম্মদ এ আরাফাত তার নিবন্ধে মরিয়ম মান্নানের কথাও উল্লেখ করেছেন, যিনি বাসা থেকে তার মা রহিমা বেগমকে অপহরণ করা হয়েছে বলে দাবি করেছিলেন। তবে এর ২৭ দিন পর রহিমা বেগমকে ফরিদপুরে খুঁজে পায় পুলিশ।
পরে জানা যায়, প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পত্তি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে ঘটে এ ঘটনা। রহিমা বেগম আত্মগোপনে গিয়ে অপহরণের নাটক সাজিয়েছিলেন বলে আদালতে জবানবন্দি দেন তার ছেলে মোহাম্মদ মিরাজ আল শাদী। ফেসবুক অ্যাকটিভিস্ট এবং সরকারের সমালোচক পিনাকী ভট্টাচার্য ২০১৮ সালে আত্মগোপনে চলে যান। কিন্তু ছয়দিন পর তিনি তার ফেসবুক স্ট্যাটাস পরিবর্তন করে আত্মগোপনে থাকার কথা স্বীকার করেন।
গত বছর আবু ত্ব-হা আদনান নামে একজন ধর্মীয় বক্তাকে নিখোঁজ ঘোষণা করে তার পরিবার। কিন্তু এর আটদিন পর তাকে গাইবান্ধায় তার অন্য স্ত্রীর বাড়িতে পাওয়া যায়। আদনান স্বীকার করেছেন, পারিবারিক অশান্তি এড়াতে তিনি আত্মগোপনে ছিলেন।
ভাইয়ের সঙ্গে জমি সংক্রান্ত বিরোধের জেরে পাঁচ মাস ধরে আত্মগোপনে ছিলেন কামারপাড়ার বাদশা মিয়া। নিজের হত্যার নাটক সাজিয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ফাঁসানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে তিন বছর আত্মগোপনে ছিলেন লালমনিরহাটের শাহজাহান আলী নাহিদ।
এ তালিকা দীর্ঘ হলেও জাতিসংঘের দাবি, তাদের সবাই ‘নিখোঁজ’ হয়েছেন। মোহাম্মদ এ আরাফাতের মতে, দাবি করা সহজ হলেও বিষয়গুলো যে এত সহজ নয়, গভীরভাবে দেখলেই তা বোঝা যায়।