হোম অর্থ ও বাণিজ্য কোন দিকে যাচ্ছে দেশের অর্থনীতি

কোন দিকে যাচ্ছে দেশের অর্থনীতি

কর্তৃক Editor
০ মন্তব্য 49 ভিউজ

নিউজ ডেস্ক:

বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক অগ্রগতির এক উজ্জ্বল উদাহরণ হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে প্রশংসিত হয়ে আসছে। তৈরি পোশাক খাত, প্রবাসী আয়, দারিদ্র্য হ্রাস, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও অবকাঠামো খাতে সাফল্যের মাধ্যমে বিশ্ব দরবারে নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করেছে। তবে সম্প্রতি প্রকাশিত দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, অর্থনীতির ভেতরে জমতে থাকা গভীর সংকট এখন আর উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। বিশ্বব্যাংকের ‘গ্লোবাল ফিনডেক্স ২০২৫’ এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সর্বশেষ হিসাব বলছে— বাংলাদেশের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি ও রাজস্ব আহরণে ধস নেমেছে। যা দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও টেকসই উন্নয়নের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আর্থিক অন্তর্ভুক্তির হার কমেছে ১০ শতাংশ পয়েন্ট

বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ ‘গ্লোবাল ফিনডেক্স রিপোর্ট’ বলছে, ২০২৪ সালে বাংলাদেশের ১৫ বছর বা তার বেশি বয়সী জনগণের মধ্যে মাত্র ৪৩ শতাংশের কোনও ব্যাংক বা মোবাইল মানি অ্যাকাউন্ট রয়েছে— যা ২০২১ সালে ছিল ৫৩ শতাংশ। অর্থাৎ, তিন বছরের ব্যবধানে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির হার এক লাফে ১০ শতাংশ পয়েন্ট কমে গেছে।

এদিকে বিশ্বব্যাপী আর্থিক অন্তর্ভুক্তির হার বেড়েছে। ১৪১টি দেশের মধ্যে বেশিরভাগ দেশেই গড় ব্যাংক অ্যাকাউন্টধারীর সংখ্যা ৭৪ শতাংশ থেকে বেড়ে ৭৯ শতাংশে পৌঁছেছে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান তুলনামূলক দুর্বল। ভারতের ব্যাংক অন্তর্ভুক্তির হার ৮৯ শতাংশ এবং শ্রীলঙ্কার ৮০ শতাংশের ওপরে। বাংলাদেশ কেবল পাকিস্তানের তুলনায় এগিয়ে আছে।

বিশ্বব্যাংক আরও জানিয়েছে, মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) বা মোবাইল মানি অ্যাকাউন্টধারীর হারও কমে এসেছে। ২০২১ সালে যেখানে ২৯ শতাংশ ছিল, ২০২৪ সালে তা নেমে দাঁড়িয়েছে ২০ শতাংশে। ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে হিসাবধারীর হারও কমে ২৪ শতাংশ থেকে ২৩ শতাংশে পৌঁছেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এই পতনের কারণ ব্যাখ্যা করে বলেন, “আগে একজন গ্রাহক একাধিক মোবাইল অ্যাকাউন্ট খুলতে পারতেন। এনআইডি ভিত্তিক একক হিসাব চালুর ফলে অসংখ্য ভুয়া ও অকার্যকর অ্যাকাউন্ট বাতিল হয়ে গেছে। ফলে পরিসংখ্যানে হ্রাস লক্ষ্য করা যাচ্ছে।”

নারী-পুরুষের অন্তর্ভুক্তিতে বেড়েছে বৈষম্য

আরও উদ্বেগের বিষয় হলো— নারী-পুরুষের মধ্যে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ব্যবধান আরও বেড়েছে। ২০২১ সালে যেখানে ‘জেন্ডার গ্যাপ’ ছিল ১৯ শতাংশ পয়েন্ট, ২০২৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১ শতাংশে। বর্তমানে নারীদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টধারীর হার মাত্র ৩৩ শতাংশ, যেখানে পুরুষদের ৫৪ শতাংশ।

বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের সংখ্যা ১২ কোটি ২৮ লাখ। এর মধ্যে ৬ কোটি ৯৭ লাখ মানুষের কোনও ধরনের ব্যাংকিং বা আর্থিক অ্যাকাউন্ট নেই। এই পরিসংখ্যান বাংলাদেশের অবস্থানকে বিশ্বের সেই আটটি দেশের কাতারে নিয়ে গেছে, যেখানে অধিকাংশ জনগণ এখনও ব্যাংকবহির্ভূত রয়ে গেছে।

রাজস্ব ঘাটতিতে টালমাটাল অর্থনীতি

একই সময়ে রাজস্ব খাতেও অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) টানা ১৩ বছর ধরে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে। সদ্য শেষ হওয়া ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এনবিআরের রাজস্ব আহরণ হয়েছে তিন লাখ ৭০ হাজার ৮৭৪ কোটি টাকা, যা সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৯২ হাজার ৬২৬ কোটি টাকা কম।

বছরের শুরুতে সরকার এনবিআরের জন্য ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল। কিন্তু বছরের মাঝপথে তা হ্রাস করেও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি এনবিআর। এই রাজস্ব ঘাটতি অর্থনীতিতে বহুমাত্রিক চাপ তৈরি করেছে— সরকারি বিনিয়োগে ছাঁটাই, উন্নয়ন প্রকল্পে বিলম্ব, ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকট এবং ঋণনির্ভরতা বৃদ্ধি পেয়েছে।

অর্থনীতিবিদদের মতে, কর ব্যবস্থার দুর্বলতা, প্রশাসনিক জটিলতা ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এর প্রধান কারণ। সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, “বর্তমান কাঠামো দিয়ে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব নয়। কর ফাঁকি ও কর অব্যাহতির সংস্কৃতি রাজস্ব ব্যবস্থাকে দুর্বল করেছে।” তার মতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে শুধু কর ফাঁকির কারণেই সরকার ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব হারিয়েছে, যার অর্ধেক ছিল করপোরেট ফাঁকি।

তিনি আরও বলেন, “বাজেট পরিকল্পনা ও রাজস্ব সংগ্রহের মধ্যে কোনও সমন্বয় নেই। এ কাঠামো পুরনো ও অকার্যকর, সংস্কার ছাড়া অর্থনৈতিক টেকসই সম্ভব নয়।”

রাজস্ব দুর্বলতায় মূল্যস্ফীতি ও বাজেট ঘাটতির চক্র

বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজস্ব ঘাটতির কারণে সরকার ক্রমাগত ব্যাংক ও অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ নিচ্ছে। যার ফলে সুদের খরচ বেড়েছে, এবং বাজারে চাহিদা-জোগান ভারসাম্য নষ্ট হয়ে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। জনগণের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় ভোক্তা ব্যয় কমেছে এবং সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির গতি মন্থর হয়েছে।

২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে উন্নয়ন বাজেটের মাত্র ৪৯ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে। এই অপ্রয়োগ অর্থনীতিতে নতুন কর্মসংস্থান ও উৎপাদন বৃদ্ধির সম্ভাবনাকে বাধাগ্রস্ত করেছে।

সংকটের মধ্যেও কিছু ইতিবাচক ইঙ্গিত

বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সরকারি ব্যয়ে কিছুটা শৃঙ্খলা এসেছে। অপচয় কমেছে এবং অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ ও সঞ্চয়ের প্রবৃদ্ধি দেখা গেছে। বিশেষ করে জ্বালানি, পরিবহন, বিদ্যুৎ ও অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ কর্মসংস্থান ও উৎপাদনকে উৎসাহিত করছে।

পদ্মা ও যমুনা রেলসেতুর মতো বড় অবকাঠামো প্রকল্প চালু হওয়ায় দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চলে নতুন অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দ্বার খুলেছে।

বিশ্বব্যাংকের মূল্যায়ন: আশাবাদের বার্তা

সম্প্রতি সচিবালয়ে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে বৈঠকে বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের ভাইস প্রেসিডেন্ট জোহানেস জুট বলেন, “বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতি বর্তমানে খুব ভালো অবস্থায় রয়েছে।”

তার মতে, এক বছর আগেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ থাকলেও এখন দেশটি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে ব্যাংক খাত, বৈদেশিক মুদ্রার স্থিতি ও এনবিআরের গঠনতান্ত্রিক সংস্কার বিশ্বব্যাংকের সন্তুষ্টি অর্জন করেছে।

বিশ্বব্যাংক চট্টগ্রাম বন্দর, লালদিয়া টার্মিনাল ও অবকাঠামো উন্নয়নে সহযোগিতা অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

সামনে কী করতে হবে?

বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশের অর্থনীতির সামনে মূল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে— রাজস্ব ব্যবস্থা শক্তিশালী করা, আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বাড়ানো, কর ফাঁকি রোধ করা এবং বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করা।

রাজস্ব কাঠামোয় ডিজিটাল অটোমেশন, কর-নীতির সংস্কার এবং প্রশাসনিক জবাবদিহি নিশ্চিত না হলে লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হবে না। অন্যদিকে, ব্যাংকিং ও এমএফএস খাতের বিশ্বাসযোগ্যতা ফিরিয়ে আনার মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষকে আর্থিক ব্যবস্থায় সম্পৃক্ত করতে হবে।

সম্পর্কিত পোস্ট

মতামত দিন